রাজশাহী মহানগর ট্রাফিক পুলিশের স্লিপ বাণিজ্য

0
39

মাসোহারার স্লিপ বাণিজ্যে মেতে উঠেছেন রাজশাহী মহানগর ট্রাফিক পুলিশ। এদিকে সার্জেন্টরা আছেন ক্যাশিয়ারের ভূমিকায় ; মামলা নয়, ব্যতিব্যস্ত নিজেদের পকেট ভরায়। ট্রাফিক বিভাগে আধুনিক পদ্ধতি করা হচ্ছে, সাথে সাথে অনিয়মের পদ্ধতিও যাচ্ছে বদলে। রাজশাহী মহানগর ট্রাফিকের বিরুদ্ধে এমন-ই ডিজিটাল অনিয়ম আর ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে।

সূত্র বলছে, যখন যে টিআই ওয়ানের দ্বায়িত্ব পান, তখন তারা পোয়াবারো। প্রতিমাসে টিআই ওয়ানের (এডমিন) মাসিক নিজস্ব আয় ১০ লাখ টাকা সাথে রয়েছে ঊর্ধ্বতন কর্তাদের কমিশন। ফলে লোভনীয় পদে বসতে চলে বড় রকমের দেনদরবারও।
প্রত্যেক এডমিন তার নিজস্ব পছন্দের মানুষ দিয়ে চালান তাদের অনিয়ম দুর্নীতি আর ঘুষ বাণিজ্য। এরই মধ্যে নগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থা উন্নত না হলেও নিজেদের পকেট ভরতে ব্যস্ত সময় পার করেন ট্রাফিকের একটি সিন্ডিকেট।
গাড়ি মালিক ও শ্রমিক সমিতিসহ শহরে চলাচল করা সব ধরনের যানবাহন থেকেই উঠানো হচ্ছে মাসোহারা। নগরীর ট্রাফিক বিভাগ গাড়ির মালিক ও শ্রমিকরা হয়রানি থেকে বাঁচতে ও জরিমানার ভয়ে নিজ থেকেই যোগাযোগ করেন ট্রাফিক অফিসের দ্বায়িত্বে নিয়োজিত দুর্নীতিবাজ কর্তা ব্যক্তিদের সাথে।

এদিকে মাসোহারার স্লিপ বাণিজ্য রমরমা’র সাথে যোগ হয়েছে “ভুয়া কেস স্লিপ”। মুলহোতা অঘোষিত ক্যাশিয়ারের দ্বায়িত্ব পালন করছেন পরিদর্শক আলিম সরকার। যোগদানের ১০ দিনের মাথায় বালু মহলের ট্রাক মালিক, বাস সমিতি, সিএনজি, অটোরিকশা, ট্রান্সপোর্টসহ নগরীতে চলাচলকৃত সব ধরনের মালিক শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি।

সচেতন নগরবাসী বলছেন, মাসোহারার কারণে সরকার বিপুল পরিমানে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ফিটনেসবিহীন গাড়ী চলাচল করায় সড়কে বাড়ছে দূর্ঘটনা, প্রতিনিয়ত ঘটছে প্রাণহানি। নগরজুড়ে অনুমোদনহীন গাড়ির ছড়াছড়ি থাকলেও ট্রাফিক পুলিশ পড়ে আছেম মোটরসাইকেল আর অটোরিকশার পেছনে।

জানা যায়, জনসাধারণ ও সরকারকে দেখানোর জন্য কিছু মামলা দিয়ে রাজস্ব আয় দেখানো হলেও প্রকৃতপক্ষে তারা ব্যস্ত আছেন মাসোহারা নিয়ে।

সূত্রমতে, মহানগর ট্রাফিক পুলিশের অঘোষিত ক্যাশিয়ারের অন্যান্য দ্বায়িত্বে আছেন, কনস্টেবল সাদ্দাম, মাহাবুব হাসান ও আজাহার। এদের মুলহোতা পরিদর্শক আলিম সরকার। অপরদিকে টিআই-১ এর অঘোষিত ক্যাশিয়ার আরো একজন পাবলিক বিভিন্ন স্থান থেকে মাসোহারা নেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

অনুসদ্ধানে জানা যায়, সিএনজি, ট্রাক, বাস, মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর থেকে মোটা অংকের টাকা তোলেন নগরীর ট্রাফিক বিভাগ। মাসে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা চাঁদা উঠানো হয় বিভিন্ন খাত থেকে। এদিকে দূরপাল্লার বাস কাউন্টার, দিনের বেলায় নগরীতে চলাচল করা ইট-বালু বহনকারী ট্রাক মালিকদের কাছ থেকেও নেওয়া হয় মাসিক চাঁদা। শুধুমাত্র ব্যাটারি চালিত রিক্সা ও অটোরিকশায় মাসিক চাঁদা আদায় করেন ৩ লাখ টাকা। যা ভাগ বাটোয়ারা হয় অফিসের প্রসিকিউশন সেকশনসহ অন্যান্য দপ্তরে। প্রতিটি অটোরিকশা থেকে মাসিক নেওয়া হয় ৩ শত টাকা । নগরী চলাচলকারী অবৈধ ভুটভুটি, নছিমন করিমন আটক করে আদায় করা টাকা অফিসের কর্মরত কনস্টেবল সাদ্দাম ও আজাহারসহ অন্যান্যরা ভাগ করে নেন। এছাড়াও অফিসে বেলাল ও মাহমুদ হাসান নামের কনস্টেবল প্রতিনিয়ত আটক ট্রাক, বাস, সিএনজিসহ বিভিন্ন ছোট বড় যানবাহনের দেনদরবার করে মোটা অংকের ঘুঁষ নিয়ে ছেড়ে দেন। আর এদের দেনদরবারে সহযোগিতা করেন প্রসিকিউশন শাখার সার্জেন্ট নুরে আলম সিদ্দিক।

তবে ট্রাফিক বিভাগে নতুন নিয়মে সরাসরি টাকা জমা দেওয়া হয় ব্যাংকে। এতে কিছুটা অনিয়ম বন্ধ হলেও নকল কেস স্লিপে চলে বাণিজ্য। এখনো ডিজিটাল মেশিনে মামলা না নিয়ে মেন্যুয়ালি নকল বা জব্দ তালিকা মুলে গাড়ি ধরা হয়। অনেক সময় নকল (বৈধ নয় এমন) কেস স্লিপ ব্যবহার করা হচ্ছে। গাড়ি জব্দের কেস স্লিপের অপব্যবহার বেশি করা হচ্ছে। আরএমপি ট্রাফিক বিভাগে দীর্ঘদিন যাবৎ উপ-পুলিশ কমিশনার হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করছেন অনির্বাণ চাকমা। ট্রাফিসের ডিসি মাসোহারার একটা বড় অংশ পান বলেও জানিয়েছে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই বিভাগের কয়েকজন। ৫ বছর ধরে তিনি এই বিভাগের দ্বায়িত্ব পালন করছেন। তার নির্দেশ ছাড়া ট্রাফিক বিভাগে কারো কিছু করার থাকেনা।

অনুসন্ধানে আরোও জানা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জের রাইসমিলের ট্রাক মালিকদের কাছ থেকে নেওয়া হয় মাসোহারা। এই মাসোহারা উঠানোর দ্বায়িত্বে আছেন সার্জেন্ট একজন , ড্রাম ট্রাকের দ্বায়িত্বে সার্জেন্ট সাদ্দাম এবং টান্সপোর্ট থেকে মাসোহারা নেওয়ার দ্বায়িত্বে আছেন নওশাদ। এভাবেই বিভিন্ন রকমের পরিবহন থেকে মাসোহারা তোলেন সার্জেন্ট সাবিহা, সাধন, ইমরান, মনির, মাহবুবসহ অনেকেই। রাজশাহীতে অবস্থিত প্রতিটি মাইক্রোবাস থেকে নেওয়া হয় মাসোহারা। ভাড়ায় চালিত প্রাইভেটকার, হাইএস, মাইক্রোবাস স্ট্যান্ড থেকে নেওয়া হয় মাসোহারা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে টি আই (ওয়ান) প্রবীণ কুমার পাল বলেন, একমাসের জন্য দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আমাকে। এ সময়ের মধ্যে শহর চিনতেই লেগে যাবে। ভালো কাজ করতে চাই আমি। এখন ট্রাফিক বিভাগ চলে আমাদের ডিসি স্যারের তত্ত্বাবধানে। তিনি সকল বিষয় জানেন ও দেখেন। আমি এখনো কারো সঙ্গে যোগাযোগ করিনি। কেউ যদি যোগাযোগ করেন, তা আমি জানি না। আমার এক মাসে কোনো অনিয়ম করার সুযোগ নাই। এখন থেকে প্রতি মাসে একজন করে এডমিনের দ্বায়িত্ব পাবেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

আরএমপির মিডিয়া মুখপাত্র অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার রফিকুল ইসলাম’র মুঠোফোন কল দিয়ে নগরীর ট্রাফিক পুলিশের ঘুষ বানিজ্য বিষয়টি শোনার পরে তিনি বলেন,আমি এখন মিটিং এ আছি এ বিষয়ে পরে কথা হবে বলে লাইনটি কেটে দেন।

এ বিষয়ে রাজশাহী মহানগর ট্রাফিক পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) অনির্বাণ চাকমা বলেন, ভুয়া কেস স্লিপের ব্যবহারের বিষয়টি সঠিক নয়। এরকম প্রমাণ থাকলে অফিসে নিয়ে আসবেন, আমি তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিবো। মাসোহারা বন্ধে প্রতিমাসে একজন করে দ্বায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। যাতে কেউ বেশি সময় এডমিনের দ্বায়িত্ব পালন করে সুবিধা নিতে না পারেন। আমার অফিস শতভাগ পরিষ্কার আছে। বাহিরে টুকটাক কিছু থাকলে তা তদন্ত পূর্বক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে